ডাইনিং টেবিল
—- লেখায়, সুদীপ্ত হালদার
গাড়ির জানলা দিয়ে মেঘে ঢাকা আকাশটা দেখতে দেখতে অর্ণবের মনে পড়লো একসময় সে বৃষ্টি ভালোবাসতো। বৃষ্টি নামলেই সে এক দৌড়ে উঠে যেতো তাদের তেতলার ছাদে। পরে যদিও মায়ের মার আর বকা দুই-ই খেতে হতো তাকে । কিন্তু মার বা বকা খাবার ভয় কখনোই বৃষ্টির প্রতি তার ভালোবাসাকে এক চুলও কমাতে পারেনি। বরং একটু হলেও হয়তো বাড়িয়েছিল।
এখনও কি অর্ণব বৃষ্টি ভালোবাসে? কে জানে! ভালোবাসলেও তা এখন ইটের তলায় চাপা পড়া ঘাসের মতো।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অর্ণব পকেট থেকে গোল্ডফ্লেক-এর প্যাকেটটা বার করলো। তারপর সেখান থেকে দুটো সিগারেট তুলে নিয়ে একটা নিজের ঠোঁটে গুঁজে আরেকটা আশেকের দিকে এগিয়ে দিলো। আশেক অর্ণবের ড্রাইভার। বছর আটেক আগে এই চাকরিটা নিয়ে অর্ণব আসানসোলে আসে। তখন থেকেই অর্ণব আশেককে চেনে। অর্ণবের কাছে আশেক এখন শুধু তার ড্রাইভার নয় বরং তার খুব ভালো বন্ধুও। যদিও আশেককে অনেকবার বারণ করা সত্ত্বেও আশেক তাকে স্যার বলে। আশেক ছেলেটা ভালো, সংসারে তার অভাব আছে কিন্তু কখনও মুখ ফুটে অর্ণবের কাছে টাকাপয়সা চায়নি। অর্ণব নিজেই মাঝে মাঝে কিছুটাকা আশেককে দেয়। আশেক প্রতিবারই প্রথমে অনেক বারণ করে কিন্তু অর্ণব সেসব শোনে না।
অর্ণবের এগিয়ে দেওয়া সিগারেটটা দেখে আশেক বললো, “স্যার আমি আর খাচ্ছি না। ছেড়ে দিয়েছি। বউ খুব রাগারাগি করে, আর ছেলেটাও বড়ো হচ্ছে…”
অর্ণব নিজেও বহুবার ভেবেছে সে আর সিগারেট খাবে না। কিন্তু শুধু ভেবেইছে, কোনোবারই সে ছাড়তে পারেনি। শাসন করার বা বারণ করার কোনো লোক থাকলে হয়তো সেও পারতো।
অর্ণব নিজের সিগারেটটা জ্বালালো। কোথায় যেন সে পড়েছিল সিগারেটের ধোঁয়া আড়াল তৈরি করে। অর্ণব একসময় বই পড়তে খুব ভালোবাসতো। লেখালেখির দিকেও তার ঝোঁক ছিল। কলেজে উঠে লিটল ম্যাগজিনও বার করেছিল অর্ণব আর তার বন্ধুরা মিলে।
এই কথাগুলো মনে পড়লে অর্ণবের খালি মনে হয় এসবকিছুই যেন আগের জন্মের কথা। এই জন্মে যেন এরম কিছু ঘটেইনি কক্ষনো। ঘটতে পারেনা।
অর্ণব তার সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললো,
– “তোমার ছেলের যেন কোন ক্লাস এখন?”
– “এই ক্লাস ওয়ানে উঠলো স্যার। এখনই মাসে ওর পড়াশোনা বাবদ খরচ হয় তিনহাজার মতো। ভাবতে পারেন! কিন্তু স্যার আমি ঠিক করে ফেলেছি, যতই কষ্ট হোক ওকে আমি পড়াবো। নুন ভাত খেয়ে থাকতে হলে তাই-ই খাবো।”
– “কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে জানিও আশেক।”
কথাটা শেষ হতেই অর্ণবের ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনে কী কথা হলো ঠিক করে বোঝা গেল না। অর্ণব শুধু কয়েকবার “আচ্ছা স্যার, ওকে স্যার, থ্যাংক ইউ স্যার” বলে ফোনটা রেখে দিলো।
তারপর কিছুক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে আশেকের দিকে ঘুরে বললো, “আমাদের আর বেশিদিন দেখা হবে না বুঝলে আশেক। অফিস থেকে আমাকে বিদেশে পাঠাচ্ছে।”
আশেক বেশ হাসি মুখেই বললো, “ভালোই তো স্যার! আমারও খুব ইচ্ছে ছিল জানেন বিদেশে যাওয়ার, তা তো আর হবে না। কিন্তু আমার ছেলে যাবে স্যার। ও ঠিক পারবে। আমার তো স্বপ্ন স্যার ও আপনার মতো বড়োমানুষ হবে, বড়ো চাকরি করবে, কোনো অভাব থাকবে না ওর।”
অর্ণবের সত্যিই কোনো অভাব নেই। ঘরে সব কিছুই তার আছে। এসি থেকে টিভি সবই এ-ক্লাস। শুধু ডাইনিং টেবিল নেই। ওটা অর্ণব ইচ্ছে করেই কেনেনি। ডাইনিং টেবিলে একা একা খেতে অর্ণবের কেমন যেন লাগে।
অর্ণবের বাবারও খুব ইচ্ছে ছিল বিদেশ ঘোরার, তিনি পারেননি, কিন্তু অর্ণব পারবে। অর্ণবের বাবা এখন রিটায়ার্ড। কলকাতার বাড়িটায় থাকেন । সঙ্গে দুজন আয়াও থাকেন। সপ্তাহে এক দু’দিন ফোনে কথা হয় তার অর্ণবের সাথে। বাকি দিনগুলো অর্ণব কাজে ব্যস্ত থাকে। বাবার ডায়বেটিস আর প্রস্টেটের সমস্যার জন্য অনেক টাকার দরকার হয়। মাসে মাসে তাই বেশ খানিকটা টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় অর্ণব।
অর্ণবের মনে পড়ে যায় অনেক কিছুই। মনে পড়ে যায়, তার বাবাও চেয়েছিলেন অর্ণব এর কোনো অভাব থাকবে না, একদিন সে অনেক বড়ো মানুষ হবে। অর্ণব বড়লোক হয়েছে, তার কোনো অভাব নেই, শুধু এক ওই ডাইনিং টেবিল ছাড়া।