ময়লা জলে কী ভাবে মাছ চাষ করা যায়? জানুন সহজ পদ্ধতি

WhatsApp Channel Join Now
Telegram Channel Join Now
Instagram Channel Follow Now

নাগরিক সভ্যতার বিস্তার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশে নির্গত সিউয়েজের পরিমাণ ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। পরিবেশে সিউয়েজ দু’ ভাবে কাজ করে। সিউয়েজের বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত পদার্থ ও দূষণ সৃষ্টিকারী উপাদান পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর। আবার সিউয়েজে প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান থাকে যা মাছ চাষের পুকুরে সার হিসাবে কাজ করে। মাছ চাষে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই সিউয়েজ ব্যবহার করতে পারলে মাছের উৎপাদন অনেকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।

সম্প্রতি মাছ চাষে সিউয়েজের ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। সিউয়েজ থেকে পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য ও বিভিন্ন প্রকার জৈব উপাদানের (biological agents) ভূমিকা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।  সিউয়েজ কথার অর্থ গৃহস্থালী, পৌরসভা ও কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ সমন্বিত কালো মিশ্রিত জল যার মধ্যে কঠিন পদার্থগুলি ভাসমান, দ্রবীভূত অথবা কোলয়েড অবস্থায় থাকে। সিউয়েজ কথাটির সমার্থক সুলেজ (sullage) থেকে এই অর্থে পৃথক যে সুলেজের মধ্যে মলমূত্র থাকে না কিন্তু সিউয়েজের মধ্যে তা থাকে।

https://news.google.com/publications/CAAqBwgKMJ-knQswsK61Aw?hl=en-IN&gl=IN&ceid=IN:en

সিউয়েজের উপাদান (Composition of sewage) 

সিউয়েজের উপাদানের মধ্যে সাধারণতঃ জলই প্রধান (99%), কঠিন পদার্থরূপে জৈব ও অজৈব পদার্থের পরিমাণ শতকরা মাত্র এক ভাগ। অজৈব পদার্থের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদান (nutrients), ডিটারজেন্ট (detergents), বিভিন্ন ধাতব মৌল (heavy metals) পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। জৈব পদার্থের মূল অংশ হিসাবে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট প্রভৃতির অবশিষ্টাংশ, প্রচুর ব্যাক্টেরিয়া ও প্রোটোজোয়া থাকে।

এছাড়া সিউয়েজের মধ্যে কয়েকটি গ্যাসীয় পদার্থ যেমন, কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂), হাইড্রোজেন সালফাইড (H₂S) ও অ্যামোনিয়া (NH3) ইত্যাদি থাকে।  সিউয়েজের উপাদান এবং তাদের অনুপাত বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন হতে পারে। স্থানীয় মানুষের খাদ্যাভ্যাস, কলকারখানার প্রকৃতি ও অন্যান্য কারণের উপর নির্ভর করে। অসংশোধিত সিউয়েজের ভৌত-রাসায়নিক ধর্ম এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আলাদা হয়। প্রায় 40 বছর আগে কলকাতা শহরের অসংশোধিত সিউয়েজের ভৌত রাসায়নিক ধর্ম (Saha, 1958) ছিল নিম্নরূপ।  ময়লা জলে মাছ চাষের ধারণা (Concept of sewage-fed fisheries)  জৈব পদার্থ সমন্বিত ময়লা জলের উর্বরতা শক্তি খুব বেশি। 1930 সালে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গে প্রথম মাছ চাষের কাজে সিউয়েজের ব্যবহার শুরু হয়। বিজ্ঞানী হেফারের মতে (1962) মাছের পুকুরে সিউয়েজকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করলে তা অজৈব সারের মতোই কাজ করে এবং জলের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের পরিমাণ বৃদ্ধি হয় এবং মাছের প্রাথমিক খাদ্য ফাইটোপ্লাংকটন পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি হয়, ফলে জুপ্লাংকটন ও অন্যান্য পোকামাকড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়। এগুলি মাছের খাবার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তাই বাইরে থেকে কৃত্রিম খাবার সরবরাহের প্রয়োজন হয় না।  ময়লা জলের সংশোধন প্রক্রিয়া (Sewage treatment process)  মাছের পুকুরে সরাসরি অসংশোধিত সিউয়েজের ব্যবহার মাছের পক্ষে ক্ষতিকর, কারণ এর মধ্যে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ খুবই কম, জৈব কার্বন ও BOD-এর মাত্রা অত্যন্ত বেশি থাকে। গ্যাসরূপে প্রচুর পরিমাণে CO₂, H₂S, এবং NH, পাওয়া যায়। তাই অসংশোধিত সিউয়েজ মাছ চাষের অনুপযুক্ত। এই সকল পুকুরে প্রচুর রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়ার (pathogenic bacteria) উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাই মাছের পুকুরে সিউয়েজ ব্যবহার করার আগে নিম্নলিখিত কয়েকটি পদ্ধতিতে পরিশোধন (treatment) করা যেতে পারে।

স্থিতিকরণ পদ্ধতি (Stabilization) 

এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন উৎস থেকে সিউয়েজ একটি পুকুরে সংগ্রহ করা হয়। কয়েক সপ্তাহ পর বিষাক্ত গ্যাসের ক্রিয়ায় ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পায়। ভারী কঠিন পদার্থগুলি জৈব পদার্থের পচন ঘটে এবং পষ্টি উপাদানগুলি মুক্ত (available form) হয়। হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসের উপস্থিতিতে বিভিন্ন প্রকার ভারী ধাতু যেমন Hg. Pb, du. Fe ইত্যাদি ধাতব সালফাইড গঠন করে পুকুরের তলায় থিতিয়ে পড়ে। জৈব পদার্থের পচনের প্রক্রিয়া নিম্নলিখিতভাবে প্রকাশ করা যায়-  (ক) জৈব পদার্থ বায়বীয় ব্যাক্টেরিয়া উদ্বায়ী জৈব অ্যাসিড → পুষ্টি উপাদান  অবায়বীয় (খ) জৈব পদার্থ ব্যাক্টেরিয়া মিথেন ও অন্যান্য গ্যাস  কখনও কখনও স্থিতিকরণ পুকুরে কয়েকটি কক্ষ দেখা যায়। নালার সাহায্যে একটি পুকুরের সঙ্গে অন্যটি যুক্ত থাকে। প্রথম পুকুরে স্থিতিকরণের পর দ্বিতীয় পুকুরে এবং অবশেষে নালার সাহায্যে পরিশ্রুত সিউয়েজ মাছের পুকুরে প্রবেশ করে। চাষের জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য স্থিতিকরণ পুকুরের জল ব্যবহার করা যায়।  আগত সিউয়েজ  প্রাথমিক/মুখ্য স্থিতিকরণ  পুকুর  গৌণ স্থিতিকরণ পুকুর  মাছ চাষের পুকুর  চাষের →সেচ জমি  স্থিতিকরণ পদ্ধতি অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে বেশি উপযোগী, কারণ পুকুরটি মাটির তৈরি এবং সৌরশক্তির দ্বারা জৈব বিক্রিয়া ঘটার ফলে পরিচর্যার জন্য খরচ খুব কম হয়।  মামুলি প্রথায় সিউয়েজ সংশোধন (Traditional way of sewage treatment)  এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন উৎস থেকে জৈব পদার্থ সমন্বিত জল ড্রেনের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় জমা হয় এবং ওই জায়গায় পচানো হয়। নিম্নলিখিত তিনটি পর্যায়ে এই কাজটি করা হয়-  (ক) থিতান (sedimentation)  (খ) লঘুকরণ (dilution)  (গ) সঞ্চয়ন (storage)  থিতান (Sedimentaion)  এই পদ্ধতিতে সিউয়েজ প্রথমেই খুব উচ্চ গতিবেগে একটি ট্যাঙ্কের মধ্যে প্রবেশ করে এবং পরে একটি চওড়া ট্যাঙ্কের মধ্যে প্রবেশ করে। ফলে গতিবেগ হঠাৎ কমে যায় এবং কঠিন পদার্থগুলি তলায় থিতিয়ে পড়ে। এই পদ্ধতিকে আরও বেশি কার্যকর করার জন্য ওই তরলকে একই ভাবে দ্বিতীয় একটি বা দুটি ট্যাঙ্কে প্রবেশ করানো হয়। এতে প্রায় অধিকাংশ (99%) কঠিন পদার্থ থিতিয়ে পড়ে এবং 33% BOD কমে যায়। তাছাড়া অধিকাংশ দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাসগুলি বেরিয়ে যায়।  ১৫.৩.২.২ লঘুকরণ (Dilution)  আধুনিক মতে লঘুকরণই দূষণের সমাধান (dilution is the solution to pollution) তাই সংশোধিত মাছের পুকুরে প্রবেশ করানোর আগে সিউয়েজের সঙ্গে জল মিশিয়ে (1:4 অনুপাতে সিউয়েজ ও জল) লঘু করতে হয়। এর ফলে বিষাক্ত গ্যাসগুলি ক্ষতিকারক মাত্রার চেয়ে কমে যায়।

সঞ্চয়ন (Storage) 

লঘুকরণের পর সিউয়েজ পুকুরের মধ্যে কয়েকদিন সঞ্চয় করে রাখতে হয়। এই সময় এতে প্রচুর পরিমাণ সবুজ ছোট ছোট শেওলা ও ফাইটোপ্লাংকটন জন্মায় কা সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার দ্বারা জলে দ্রবীভূত ০₂এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে জল মাছ চাষের উপযোগী হয়।  ১৫.৪ মাছ চাষে সিউয়েজের ব্যবহার (Use of sewage in fish culture)  নিম্নলিখিত ভাবে সিউয়েজ ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।  (ক) প্রথমে সিউয়েজের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী বিচার করতে হবে।  (খ) মাছ ছাড়ার আগে সংশোধন করা সিউয়েজ দিয়ে পুকুরে সেচ দিতে হবে।  (গ) পরিষ্কার জল মিশিয়ে সিউয়েজ লঘু করতে হবে।  (ঘ) কয়েকদিন পুকুরটিকে স্থিরভাবে ফেলে রাখতে হবে।  (ঙ) উপযুক্ত অনুপাতে মাছের পোনা ছাড়তে হবে।  (চ) মাছ ছাড়ার পরে আবার একবার লঘু সিউয়েজ দিয়ে সেচ দিতে হবে।  (ছ) প্রায় 7 মাস পালন করার পর মাছগুলির ওজন । কিলোগ্রাম হলে মাঝে মাঝে  মাছ ধরতে হবে। (জ) শেষে 12 মাসের মধ্যে সমস্ত মাছ ধরে ফেলতে হবে।

ময়লা জলে চাষ করার উপযোগী বিভিন্ন মাছের প্রজাতি (Culturable species) 

তিলাপিয়া, কাতলা, সিলভার কার্প, সাইপ্রিনাস, রুই, পুঁটি, ট্যাংরা, শিঙি, ল্যাটা প্রভৃতি মাছ ময়লা জলে চাষ করা যায়, তবে এর মধ্যে তিলাপিয়া মাছই সবচেয়ে বেশি চাষোপযোগী, কারণ এরা কম অক্সিজেন যুক্ত ময়লা জলে বেঁচে থাকতে পারে এবং এদের বৃদ্ধিও খুব বেশি। তবে পোনা মাছ চাষের জন্য সিউয়েজকে খুব ভালভাবে সংশোধন করতে হয়।

Author

এই খবরটা তাঁর সঙ্গে শেয়ার করুন, যার এটা জানা দরকার

Make your comment